দেনমোহর বা কাবিন

মানব জীবনের এক বিশেষ পর্ব হলো বিয়ে। পরিপূর্ণ সামাজিক মানুষ হিসেবে পথ চলা শুরু হয় এই বিয়ের মাধমেই। ইসলাম ধর্মতে বিয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দেনমোহর

দেনমোহর কি?

দেনমোহর হলো স্ত্রীর প্রতি সম্মানসূচক স্বামীর একটি আবশ্যিক দেনা।মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো কিছু টাকা বা অন্য কোনো সম্পত্তি যা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের মূল্যস্বরূপ পাওয়ার অধিকারী হয়.অন্যভাবে বলা যায়, বিয়ে উপলক্ষ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে বাধ্যতামূলক যে নগদ অর্থ, সোনা-রূপা কিংবা স্থাবর সম্পদ দিয়ে থাকেন, তাই দেনমোহরইসলামী শরীয়া আনুযায়ী দেনমোহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ইসলাম ধর্মমতে বিয়েতে প্রদানকৃত এই দেনমোহর স্বামীর কাছে স্ত্রীর অধিকার ।

দেনমোহর পরিশোধের নিয়মঃ 

বিয়ের সাথে সাথে এই দেনমোহর দেওয়াটা সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত।তবে এটি নানা ভাবেই পরিশোধ করা যেতে পারে। যেমন নগদ অর্থ বা সোনা/রুপার অলংকার ছাড়াও মূল্যবান জিনিসপত্র বা স্থাবর অস্থাবর সম্পদ দিয়েও হতে পারে। অর্থাৎ বিনিময় মূল্য আছে এমন যে কোন প্রকার বস্তু দ্বারা মোহর পরিশোধ করা যেতে পারে।

 ঐতিহাসিক কোন বস্তু দ্বারা দেনমোহর প্রদান করা উচিৎ নয় কেননা স্থান কাল,পাত্র ভেদে এর দামে ভিন্নতা আসতে পারে।

স্ত্রীর করনীয়ঃ

দেনমোহর স্বামীর দেয়া কোন উপহার বা দান নয়, এটা স্ত্রীর অধিকার একই সাথে স্বামীর স্ত্রীর প্রতি আবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য,দেনমোহরকে আল্লাহপাক স্বামীদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। ।কোন ব্যক্তি যদি এই দেন মোহর পরিশোধ না করেন তাহলে তা দেনা হয়ে থাকবে।এ প্রসঙ্গে পবিত্র  কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন। “আল্লাহ তাআলা বলেন

আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহর কিছু অংশ কিংবা সম্পূর্ণ অংশ ছেড়ে দিতে পারে। [সূরা আন-নিসাঃ৪]

তবে ক্ষেত্রে দেনমোহর কমানো বা মাফ করার জন্য স্ত্রীর উপর কোন প্রকারের চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণভাবে দেনমোহর কম ধার্য করাই মুস্তাহাব।স্ত্রীদের উচিৎ স্বামীকে দেনমোহর প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া। স্বামীকে তা সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প অল্প করে পরিশোধ করতে বলা।কারন স্ত্রী মাফ করেছি বললেও তা মাফ হবে না।

দেনমোহর ও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটঃ

বর্তমান সময় বিয়ের ক্ষেত্রে এই দেন মোহর প্রদান কিছুটা লোক দেখানো হয়ে গেছে। কে কত দেনমোহরে বিয়ে করল বা কে তার মেয়ে/ ছেলে কে কত টাকা দেনমোহরে বিয়ে দিলো তা যেন এখন সামাজিক পদমর্যাদার মাপকাঠি ।বিয়ের আসরে দেনমোহর নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় অনেক বিয়ে যেমন ভাঙছে তেমনি বিয়ের পর পারিবারিক অশান্তিতে অনেক সংসারও ভাঙছে ।কারন লোক দেখানো মোহরানা প্রদানে থেকে না কোন বরকত বরং তা অহংকারের পরিচায়ক।

বরকতপূর্ণ বিবাহের বর্ণনা দিয়ে উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে, অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।”-মিশকাত শরিফ

আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজকাল কনে পক্ষ তার কনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতেও বেশি পরিমান দেন মোহর বেঁধে দিতে চায়।কারন আমাদের দেশে ইদানিং কালে ডিভোর্সের পরিমান অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে।এক জরিপে দেখা গেছে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই এক দিনে ৩৯ টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটছে,এ কারণেই উচ্চ মোহরানার দাবি করা হচ্ছে।

 তবে দেনমোহরের পরিমাণ কী হওয়া উচিত ইসলামী শরীয়াতে এ সম্পর্কে বিশেষভাবে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি, এমনকি কোন সুস্পষ্ট পরিমাণ ঠিক করে ও দেয়া হয়নি। তবে কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়া ঢালাওভাবে সবার জন্য একই দেনমোহর নির্ধারণ করলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে- যা ইসলাম আদৌ পছন্দ করে না।

মোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ দেনমোহর পরিশোধের সামর্থ্য যদি স্বামীর থাকে তবে সেক্ষেত্রে দেনমোহরে ফাতেমিকে দেনমোহর নির্ধারণ করার দ্বারা স্ত্রীকে ঠকানো হয় ও নারীত্বের অবমাননা করা হয়। তাই দেনমোহরে ফাতেমিকে নয়, বরং স্বামীর সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ পরিমাণকে দেনমোহর করা উচিৎ।

এ কথা স্পষ্ট যে, প্রত্যেক স্বামীরই কর্তব্য হচ্ছে তার আর্থিক সামর্থ্য ও স্ত্রীর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে উভয় পক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বেঁধে দেয়া। এবং মেয়ে পক্ষেরও উচিৎ তাতে সহজেই রাজী হয়ে যাওয়া ।

ইসলাদেশ নির্দেশঃ

দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। ন্যূনতম পরিমান হানাফি মাজহাবের মতে ১০ দিরহাম।সম্প্রতি সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে দেখা যায়, এক টাকা দেনমোহরে বিয়ে কিংবা নামমাত্র অংকের দেনমোহরে বিয়ে করেছে যুবক-যুবতী . অনেক ইসলামিক স্কলারের মতে, যদি ১০ দিরহামের কমে কোনো নারী দেনমোহর নির্ধারণে রাজি হয় তবে এ দেনমোহর ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করা মোহরানার ক্ষেত্রে উত্তম । এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা হলে এবং তাতে  স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না।

এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি শরীফ, ৭/২৪০)। কিন্তু এর উপরে যে কোনো পরিমাণকেই দেনমোহর নির্ধারণ করা যাবে। তবে স্বামী যেহেতু দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য- তাই তার পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা উচিৎ। এমন কোনো সিদ্ধান্ত তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া আদৌ উচিৎ হবে না- যাতে সে তা পরিশোধ না করতে পেরে গুনাহগার হয়।

পরিশেষে বলতে চাই। আমাদের সবার উচিৎ বিয়ের বরকতের দিকে নজর দেয়া। বিয়ের মোহরানাকে কখনই সামাজিক মর্যাদা পরিমাপের মাপকাঠি ধরা উচিৎ নয়।

 

 

SCAN TO VIEW

OUR OFFICES